চকরিয়া নিউজ ডেস্ক ::
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের মাঝে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ (মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-লাওস) এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান) এর একেবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে এদেশে মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটছে।
তিন দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার। দুই প্রতিবেশি দেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষা এলাকা দিয়ে মাদক আসে। ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে হেরোইন, ফেন্সিডিল, গাঁজা এবং ইঞ্জেক্টিং মাদক অ্যাম্পুল। মিয়ানমার থেকে ঢুকছে সর্বনাশা ইয়াবা।
মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, তাকি, বশিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুরিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাও, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদীয়া, মালদাহ, বালুরঘাট, আরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুরে মাদক ঢুকছে।
ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেষা এলাকাগুলোর ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায়।
বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং ফেনীতে।
এছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁয় ফেন্সিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়ার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ডিএনসি।
এসব রুট দিয়ে দেশে হেরোইন, ফেন্সিডিল, গাঁজা ঠেকাতে বাংলাদেশের আহ্বানে ভারত ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে ফেন্সিডিল ও তৈরির উপকরণ সরবরাহ এবং বহন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত।
এরপরও সীমান্ত সংলগ্ন কয়েকটি জেলায় ফেন্সিডিলের অনুপ্রবেশ ঘটছে জানিয়ে ডিএনসি’র মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বেশ কিছু জেলাতে ফেন্সিডিলের প্রাদুর্ভাব এখনো বড় সমস্যা।
তবে মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ঢুকছে কোটি-কোটি পিস ইয়াবা।
ডিএনসি’র সনাক্ত করা মাদক রুট
ইয়াবার অবাধ প্রবেশে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে ডিএনসি মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন: যেভাবে মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবার অনুপ্রবেশ ঘটছে সেটা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। কক্সবাজার, কক্সবাজার উপকূলবর্তী সমুদ্রপথ এবং টেকনাফসহ সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে। আমরা জানতে পেরেছি, ইয়াবা এখন গভীর সমুদ্র দিয়ে চলে যাচ্ছে ভারতে। ভারত থেকে এসব ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
ডিএনসি’র সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, বেশির ভাগ ইয়াবা তৈরি হয় মিয়ানমার-চীন সীমান্তের শান এবং কাচিন প্রদেশে। মিয়ানমারের সাবাইগন, তমব্রু, মুয়াংডুর মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, ধূমধূমিয়া, কক্সবাজার হাইওয়ে, উখিয়া, কাটাপাহাড়, বালুখালি, বান্দরবানের গুনদুম, নাইখ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার মতো অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে।
ইয়াবা প্রবেশের পথ প্রসঙ্গে ডিএনসি’র অপারেশন্স এবং গোয়েন্দা শাখার পরিচালক সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন: আসলে ইয়াবার জন্য মিয়ানমারের পছন্দের বাজার ছিলো থাইল্যান্ড। কিন্তু এরপর আমাদের দেশে এই মাদকের আসক্তের সংখ্যা কল্পনার বাইরে চলে যাওয়ায় ইয়াবার বড় বাজারে পরিণত হয় বাংলাদেশ। এই বাজারের চাহিদা মেটাতে কক্সবাজার-টেকনাফের স্থল সীমান্তবর্তী ৬০-৭০টি স্পট দিয়ে দেশে ইয়াবা ঢুকছে। পানিপথে সমুদ্র উত্তাল থাকলে ইয়াবা আসা কিছুদিন কম থাকে। এরপর শান্ত সমুদ্র দিয়ে আবারও বিপুল ইয়াবা আসতে শুরু করে। কক্সবাজার, টেকনাফ সংলগ্ন উপকূলবর্তী সমুদ্রে প্রায় ৩ লাখেরও বেশি ছোট-বড় নৌযান চলাচল করে। এসব নৌযানে করে ইয়াবার চালান আসে।
ডিএনসি প্রতিবেদনে ইয়াবা পাচারের রুট
তবে এই অঞ্চলে ইয়াবা অনুপ্রবেশ বন্ধে কড়াকড়ি হলে বিকল্প রুট ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন: সনাক্ত করা স্পটগুলোতে কড়াকড়ি হয় বলে ইয়াবা পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত রুট বদলায়। স্থলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়াকড়ি হলে ইয়াবা পাচারকারীরা গভীর সমুদ্র দিয়ে ট্রলারে বরগুনা,পটুয়াখালীর দিকে চলে যাচ্ছে। গত ১ বছর ধরে আমরা এই প্রবণতা লক্ষ্য করছি। ৫০ শতাংশ ইয়াবা এখন দেশে ঢুকছে এই পথে।
তিনি জানান, এই মাদক বহনকরা সহজ, অল্পতেই অনেক টাকা আয়ের সুযোগ করে দেয়ায় সীমান্ত সংলগ্ন অনেকেই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। নগদ লাভের সুযোগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রচুর ইয়াবা বাংলাদেশে চালান করছে মিয়ানমার। কিন্তু এই মাদক পাচার বন্ধে বার বার বাংলাদেশের আহ্বান, প্রস্তাব এড়িয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার।
এসব রুট দিয়ে প্রতিবছর দেশে ঢুকছে হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল, কয়েক কেজি হেরোইন এবং কোটি কোটি পিস ইয়াবা। ডিএনসি’র দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে এসব রুট দিয়ে আসা ৪ কোটি ৭৯ হাজার পিস ইয়াবা, ৪০১ কেজি হেরোইন, ৭ লাখ ২০ হাজার বোতলের বেশি ফেন্সিডিল এবং ৬৯ হাজার ৯৮৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
পাঠকের মতামত: